|
ভগবৎ গীতা |
আমি ভগবত গীতা ততদিন পাঠ করিনি যতদিন আমার জ্ঞান হয়নি যে আমরা সবাই আত্মা | আমাদের এই জীবন আত্মার জন্য এক পরীক্ষা, এবং নিজেদের ভিতরের সব থেকে সুন্দর গুণগুলোকে ফুটিয়ে বের করে তোলা | আর ভগবদ্গীতা হলো এই পরীক্ষায় পাশ করার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ | ভগবৎ গীতার আঠারো অধ্যায় আছে, আর এই জ্ঞান সংস্কৃত ভাষায় পরমাত্মার থেকে প্রাপ্ত | সময়ের সাথে সাথে সংস্কৃত ভাষা বিলুপ্ত হয়ে চলেছে, আর এই জ্ঞান মানুষের থেকে বহু দূরে চলে যাচ্ছে | সময়ের সাথে ভগবদ্গীতার জ্ঞান বহু পন্ডিত ব্যাক্তি সহজ ভাষায় অনুবাদ করছে, তারই সাথে এই প্রচেষ্টাকে চালিয়ে যেতে আপনাদের আশীর্বাদে ভগবৎ গীতার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে, সহজ ভাষায় আমি আপনাদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছি |
এই জ্ঞান পরমাত্মা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা, সব থেকে বড় ধর্ম যুদ্ধ, মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের ময়দানে অর্জুনকে প্রায় 5000 বছর আগে দিয়েছিল | তখন সময় এমন ছিল যে ধর্মের উপর বারবার আঘাত আসছিল, পরমাত্মার ভয় মানুষের মন থেকে চলে যাচ্ছিল, লোভ লালসার কারণে, ভাই ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে তৎপর হয়ে উঠছিল, শুধু তাই নয় এক ভরা রাজসভায় সমস্ত ধর্ম বীর দের সামনে কুল বধুর অপমান হয়েছিল | সেই কারণেই দ্বাপর যুগ শেষ করে মানুষ সম্পুর্ণভাবে কলি যুগে প্রবেশ করার আগে, মহাভারতের যুদ্ধ ক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু সময় আগে, পরমাত্মা গীতার জ্ঞান ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দাঁড়া মনুষ্য জাতির কল্যাণের জন্য দিয়ে গেছেন | ঠিক তেমনি যেমন কোরান, বাইবেল, গুরুগ্রন্থ সাহেব, তোরাহ |
গীতা, বাইবেল, গুরু গ্রন্থ, কোরান, তোরাহ, এই সমস্ত পরমাত্মার থেকে পাওয়া জ্ঞান, যা কোন এক ধর্মের জন্য নয় সমস্ত মনুষ্য জাতির জন্য, সমস্ত মানব সভ্যতার জন্য | সবই আত্মার জন্য, কারণ এই আত্মার পরমাত্মার সম্বন্ধে, তার সৃষ্টির সম্বন্ধে | আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বইতে সেইসব টেকনিক সম্বন্ধে বোঝায়, যেসব নিয়ম আত্মার, মনুষ্য শরীরে থাকাকালীন পালন করা উচিৎ ও তার রক্ষা করা উচিৎ | এই নিয়ম কানুনের মাধ্যমে আত্মা শরীর ত্যাগ করার পরে বিচার করা হয়, আর এই পরীক্ষাতে পাশ করতে পারলেই চিরতরে জন্ম মৃত্যু খেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় | পরমাত্মা ভগবত গীতায় বলেছেন আমি সৃষ্টির মূল, সৃষ্টির আগেও ছিলাম, আমি ধ্বংসের পরেও থাকব, সব কিছুই আমার, আমি এই সব কিছুর মধ্যে, যা কিছু তুমি ছুঁতে পারো, দেখতে পারো, আস্বাদন করতে পারো, ঘ্রান গ্রহণ করতে পারো, এই সবকিছুই আমি, এই চাঁদ, সূর্য, নদী, পাহাড়, আর ও যা কিছু দেখো সব আমি তৈরি করেছি, আমি ভগবান, শয়তান, অসুর, মানুষ, সবকিছু বানিয়েছি, আমি সর্বব্যাপী, সবকিছুর মধ্যে আছি, যা কিছুই দেখছো সবকিছুই আমি, আমি, আর আমি | আমি সৃষ্টির অধিপতি প্রজাপতি ব্রহ্মা হয়ে সবকিছু সৃষ্টি করি, আমি ধ্বংসের অধিপতি রুদ্র হয়ে সবকিছু ধ্বংস করি, আমি সমস্ত কিছু এই ভাবেই সৃষ্টি ও ধ্বংস করে যাব, যাতে আত্মা সুযোগ পায় এই জন্ম ও মৃত্যু থেকে মুক্তি পাওয়ার | এই জন্ম মৃত্যু খেলা থেকে মুক্তি পেয়ে চিরতরে পরমাত্মার সাথে মিলিতো হওয়ার | ভগবত গীতা বলে আত্মার এই পরীক্ষার জন্য প্রকৃতির নির্মাণ পঞ্চতত্ত্ব দিয়ে করা হয়েছে, অগ্নি, পৃথ্বী, বায়ু, জল, ও আকাশ | যেগুলো আমরা স্পর্শ করে, দেখে, শুনে, ঘ্রাণে, অনুভবের দ্বারা উপলব্ধি করতে পারি | কিন্তু পরমাত্মা এই সমস্ত কিছু থেকে আলাদা, এই সমস্ত কিছুর বাইরে | পরমাত্মাকে, আত্মা শরীরের এই ইন্দ্রিয় গুলোর দ্বারা কখনোই উপলব্ধি করতে পারে না | আত্মা এমন ভাবেই শরীরে অবস্থান করে, ঠিক যেন কোন রোবট, রোবট যেমন নিজের সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে কিছুই জানেনা | ঠিক তেমনি ইন্দ্রিয় দ্বারা পরমাত্মাকে জানা সম্ভব নয়, অর্জুন কে ও পরমাত্মার বিরাট রুপ দেখার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে দিব্যদৃষ্টি দান করেছিল | ভগবত গীতা থেকে জানা যায় যে আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ মারতে পারে না, কাঁটতে পারেনা, জ্বালাতে পারে না, ভেজাতে পারে না | পরমাত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন হতে গেলে এইপরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে, এই পরীক্ষার জন্য আত্মার এই কোন না কোন শরীর নিয়ে জন্ম গ্রহণ করতেই হবে | আর চুরাশি লক্ষ যোনি ভেদ করে জন্ম এবং মৃত্যু, ভোগ করার পর এই মানব শরীর এবং মন প্রাপ্ত হয় | সব থেকে বড় পরীক্ষায় বসার জন্য আত্মার এই মানব শরীরের সাথে বিভিন্ন ধরনের ভালো ও মন্দের চক্রভিউতে, নিজের আত্মীয়-স্বজন ও ভাই বোনের সঙ্গে পাঠানো হয় | এতে সবার তার নিজের রাজসিক ও তামসিক অপ গুণ থেকে বের হয়ে, সাত্ত্বিক গুণে প্রবেশ করার সুযোগ পায় | আমাদের তামসিক গুন সেগুলো, যা আমাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের খারাপ চিন্তা সৃষ্টি করে, আমাদের হতাশাগ্রস্ত ও বিষন্ন ময় জীবন করে তোলে, আমাদের মন ঈর্ষা ও লোভর সৃষ্টি করে অন্যের ক্ষতি করার মানসিকতা সৃষ্টি করে | এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রত্যেক আত্মার, তামসিক ও রাজসিক গুণ, ত্যাগ করে নিজের সাত্ত্বিক গুণের সাথে পরিচিত হতে হবে |
সাত্ত্বিক গুণ তাকে বলে যা আমাদের এই প্রকৃতির সমস্ত কিছুর সাথে মিলিত করেন ও প্রকৃতি কে ভালোবাসতে শেখায় | এই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে মানুষের চারটি স্তর পার করতে হবে, ধর্ম, অর্থ, কাম, আর মোক্ষ | এগুলোই সেই দুয়ার যা পার করেই আত্মা, পরমাত্মা সম্পর্কে জানতে পারে | প্রথম দুয়ার ধর্মের, এর প্রতীক হলো সিংহ | ধর্ম তাই যা গীতায় লেখা আছে, বেদে লেখা আছে, গুরুগ্রন্থে লেখা আছে, বাইবেল অথবা কোরানে লেখা আছে | ধর্ম তাকে বলে যা ধারণ করা হয়, যা আপনার মন সঠিক বলে ধারণা করে, যেমন মিথ্যে বলতে নেই, চুরি করতে নেই, লোক ঠকাতে নেই, সৎ কর্মের দ্বারা জীবন যাপন করা, এই সবকিছুই ধর্ম | আর প্রত্যেক আত্মার নিজের জীবদ্দশায় যে কোন মূল্যেই এইটা ধর্মের পালন করা উচিত এবং এই ধর্মের রক্ষা করা উচিত |
দ্বিতীয় দুয়ার অর্থের, এর প্রতীক ঘোরা, প্রত্যেক আত্মা পৃথিবীতে নিজেদের উপস্থিতির মূল কারণের অর্থ জানতে পারে এবং আত্মা, ভালো সন্তান, ভালো ভাই-বোন ভালো স্বামী-স্ত্রী ভালো বন্ধু, ভালো সজন, এবং আরো যত সম্পর্ক আছে সমস্ত সম্পর্ক ভালোভাবে সবার সাথে মিলিত হয়ে এই পরীক্ষায় পাস করা |
তৃতীয় দুয়ার কামের ভগবত গীতা বোঝায় যে মানুষের শরীরে ছয়টি রিপু, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহংকার, আর ঈর্ষার বিচার মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়, যা নিজের এবং অন্যের অত্যন্ত ক্ষতি করে | এই বিচার গুলোকে প্রত্যেক মানুষের নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে | এই ছয় রিপুর কোন এক রিপুর বসে করা কর্ম আমাদের সমস্ত জীবনের দুঃখের কারণ হতে পারে | আর আত্মা এই সমস্ত রিপুর প্রভাব থেকে শান্তহয়ে, সাবধানতা অবলম্বন করে ভালোভাবে বিজয়ী হতে পারে |
চতুর্থ দুয়ার মোক্ষ, এর এর প্রতীক হাতি | এই পরীক্ষা রুপি জীবনে প্রত্যেক মানুষই কিছু ইচ্ছা পোষণ করে, কিছু ইচ্ছা মনুষ্য জীবনে পুরন হয়, আর ইচ্ছা পূরণ হয় না, সেই বাকি ইচ্ছে গুলো পূরণ করার উদ্দেশ্যে, আত্মার আবার জন্মগ্রহণ করতে হয় | ভগবত গীতা বোঝায় যে আমাদের ইচ্ছাই মূল কারণ, এই জন্ম মৃত্যুর খেলায় ফিরে আসার | আর যদি আমরা কোন ইচ্ছা না রাখি তাহলে আমরা এই জীবন মৃত্যু থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে পারি |
এই দুয়ার ক্ষমারও যারা আপনার ক্ষতি করেছে তাদের ক্ষমা করে দেওয়া, যাদের সঙ্গে আপনি খারাপ করেছেন তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার |
এই চার দুয়ার পার করেই আত্মা মুক্তি পেতে পারে, যতক্ষণ না আত্মা ধর্ম, অর্থ, কাম, এবং মোক্ষ, এর জ্ঞান প্রাপ্তি না করতে পারে, ততক্ষণ মুক্তি হওয়া সম্ভব নয়, তাহলে আত্মাকে বারবার কোন না কোন শরীর ধারণ করে জন্ম মৃত্যুর খেলায় আসতেই হবে | এই পরীক্ষা শেষ হলেই আত্মা শরীর ও অন্য সমস্ত জাগতিক বস্তুর ও মায়া ত্যাগ করে পরমাত্মার সাথে মিলিত হয়, যা কিছু এই সংসারে থেকে জোগাড় করেছে, তা এখন অন্য কারো হবে | আর আত্মা নিজের কর্ম অনুযায়ী ফল ভোগ করে | আত্মা কিছু সময়ের জন্য নিজের শুভ কর্মের জন্য স্বর্গ ও অশুভ কর্মের জন্য নরক যন্ত্রণা ভোগ করে | নরকে আত্মা পাপ অনুযায়ী সাজা ভোগ করে, আর সাজা শেষ হলে আবার কোন শরীর ও মস্তিষ্ক ধারণ করে জন্ম মৃত্যুর খেলার আবদ্ধ হয়, এবং সেই পরীক্ষায় আবার অংশগ্রহণ করতে হয়, আবার সেই একই নিয়মে পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয় | সেই চার স্তম্ভ ধর্ম, অর্থ, কাম, মোহ, বোঝার জন্য | প্রত্যেক জন্মেই আত্মার তার পূর্বজন্মের কর্মফল অনুসারে ভালো এবং খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয় | যত সময় আত্মা, পরমাত্মার এই যোগ বুঝতে না পারে, ততক্ষণ মুক্তি পায় না | ভগবত গীতায় জানা যায় মানুষ নিজের শরীর, বুদ্ধি ও মন দ্বারা ভগবান লাভ করতে পারে |
শরীর দ্বারা কর্ম করে ভগবান লাভ করাকে কর্মযোগ বলে | এমন কর্ম যা ভগবানের নির্দেশ অনুসারে হয়, অন্যের কল্যাণের জন্য হয় |
আবার বুদ্ধির দ্বারা ঈশ্বর লাভ করা যায় | একে জ্ঞানযোগ বলে মানুষ নিজের আস্থা, শ্বাস প্রণালী, সাধনা, তপস্যা, এবং যোগের মাধ্যমে, ঈশ্বর লাভ করতে পারে, এই যোগ বুঝতে গেলে আমাদের শরীরের মধ্যে থাকা কুণ্ডলিনী শক্তি সম্পর্কে বুঝতে হবে | আত্মা, মেডিটেশন অর্থাৎ ধ্যানের মাধ্যমে মস্তিষ্কে দ্বারা, পরমাত্মার সঙ্গে সম্পর্ক করতে পারে, আদি গুরু শঙ্করাচার্য, গৌতম বুদ্ধ, স্বামী বিবেকানন্দ, এবং এদের মতো আরও অনেক মহাপুরুষ বুদ্ধির দ্বারাই পরমাত্মা লাভ করেছিলেন |
ভগবত গীতা থেকে জানা যায় যে ভগবান তারাও লাভ করতে পারে, যাদের কর্মযোগ জ্ঞানযোগ সম্পর্কে কিছুই জানা নেই | তারা শুধুমাত্র মনের দ্বারা ঈশ্বর লাভ করতে পারে | একে ভক্তি যোগ বলে | ভক্তি ভরে ঈশ্বরের আরাধনা করা, নিজেকে ঈশ্বরের চরনে সমর্পণ করে, জীবের কল্যাণ করা | যেমন চৈতন্য মহাপ্রভু, মীরাবাঈ, এবং ভগবান শ্রী হনুমান ভক্তি মার্গে ঈশ্বর লাভ করেছিলেন |
আবার যদি কখনো আত্মা নিজের স্বরূপ ভুলে ধর্মের উলঙ্গ করে এবং ধর্মের উপর আঘাত করে, তা ঠিক করার জন্য পরমাত্মা কোন না কোন রূপ নিয়ে অবতরণ করেন |
আসুন আমরা সকলে পরমাত্মা দ্বারা প্রাপ্ত ভগবত গীতা বাইবেল, কোরান, গুরু গ্রন্থ, তোরাহ, এই ধরনের গ্রন্থ, পুরো পড়ে পরমাত্মার সম্পর্কে জানি এবং মোক্ষ লাভ করে পরমাত্মার সাথে মিলন হওয়ার চেষ্টা করি |
যদি এই লেখা আপনাদের ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে আমাদের জানাবেন এবং শেয়ার করে অন্যদের জানার সুযোগ করে দেবেন ঈশ্বর সকলকে সঠিক রাস্তা দেখাও এই বলে আজকের লেখা শেষ করছি নমস্কার
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মতামত প্রকাশ করুন