|
স্প্যানিশ ফ্লু |
আজ থেকে একশত বছর পূর্বে 1918 থেকে 1920 পর্যন্ত, পৃথিবীর বুকে ঘটে গেছে এক ভয়ঙ্কর মহামারী | এই মহামারী কেড়ে নিয়েছে পৃথিবীতে প্রায় 5 থেকে 10 কোটি মানুষের প্রান | এটি মানব ইতিহাসের সবথেকে ভয়ঙ্কর মহামারী | 50 কোটির বেশি মানুষ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়, এই জনসংখ্যা তখনকার সময় বিশ্বের প্রায় এক চতুর্থাংশ | প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল এই মহামারী কোন ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে জানা যায় যে এই তথ্য ভুল, কারণ এই মহামারি'র জন্য দায়ী হলো এক নতুন ধরনের ভাইরাস এইচ ওয়ান এন ওয়ান | প্রাথমিক পর্যায়ে এই ভাইরাসের নাম ছিল
স্প্যানিশ ফ্লু | স্প্যানিশ ফ্লু নাম শুনে মনে হতে পারে যে এর উৎপত্তি স্পেনে, কিন্তু তেমনটি একদমই নয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলে 1914 থেকে 1918 পর্যন্ত | স্পেন কোন দেশের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি | যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা বেশিরভাগ দেশের সংবাদ মাধ্যম স্বতন্ত্র ছিলনা, তারা সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো খবর প্রকাশ করতে পারত না | ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে এই ভাইরাসের দ্বারা মহামারী ছড়িয়ে পড়লেও তাদের সরকার চাইতো না দেশের জনগণ এই ভাইরাস সম্বন্ধে জানতে পারুক | যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সেনাদের মনোবল বজায় রাখার জন্য তারাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন |
ইতিমধ্যে স্পেনের রাজা এই ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়, এবং স্পেনের সংবাদমাধ্যম এই ভাইরাসের সম্বন্ধে সর্বপ্রথম সংবাদ প্রকাশ করে, তখন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যম, এই ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসেবে স্পেনকে দায়ী করে | স্পেন ছিল নিরপেক্ষ দেশ, এই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার কারণে অন্যায় ভাবেই ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে জড়িয়ে এই মহামারীর ভাইরাসের নামকরণ করা হয়, "
স্প্যানিশ ফ্লু" | শতবর্ষ আগের এই মহামারীর ভাইরাস, এখনো সেই স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত | এই ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল স্পেন না হলেও, স্পেনে এই ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে স্পেনের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন দিতে হয়েছিল | এই ভাইরাসের মহামারী যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশ গুলোত শুরু হয়ে সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে | ভাইরাসের দ্বারা সব থেকে বেশি প্রাণহানি হয়েছিল এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোতে, এখানকার মৃত্যুর হার ছিল ইউরোপের দেশগুলো থেকে বহুগুণ বেশি | এমনকি প্রশান্ত মহাসাগরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ গুলোতেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে ছিল | স্প্যানিশ ফ্লুর থেকে পৃথিবীর কোন অংশে রক্ষা পায়নি |
ভারতবর্ষে স্প্যানিশ ফ্লু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের থেকে ফিরে আসা সৈনিকদের মাধ্যমে ছড়ায় বলে মনে করা হয় | এই ভাইরাস দুই ধাপে ভারতবর্ষকে গ্রাস করেছিল, প্রথম ধাপ 1918 সালের বসন্তের সময়, এর উপসর্গ ছিল, জ্বর, সর্দি, কাশি, অবসাদ, ইত্যাদিতে কিছুদিন, ভোগার পর সুস্থ হয়ে যেতেন, সেই সময় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল খুব কম, অর্থাৎ ভাইরাসের প্রভাব ছিল মৃদু | বসন্ত পেরিয়ে আবার শরৎকাল আসতেই এই ভাইরাসের দ্বিতীয় প্রকোপ শুরু হয়, তখন এই ভাইরাসের মারণ ক্ষমতা আরো তীব্র হয়ে ওঠে | ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিনের মধ্যেই মানুষের মৃত্যু হয়ে যেত |
এই ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ফলে, মানুষের নিঃশ্বাস নিতে প্রচন্ড কষ্ট অনুভব করতো, দম বন্ধ হয়ে আসত,এবং নাক ও মুখ দিয়ে প্রচন্ড পরিমানে রক্তক্ষরণ হয়ে, অক্সিজেনের অভাবে শরীর নীলচে বর্ণের হয়ে মানুষ মারা যেত | তখনকার সময়ও এই ভাইরাসের প্রতিরোধ করবার জন্য স্কুল, কলেজ, থিয়েটার, সমস্ত কিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, এবং মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা, বারবার হাত ধোয়া, মাক্স ব্যবহার করা, ইত্যাদি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল | কিন্তু পরাধীন ভারতবর্ষে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো না থাকার কারণে, এই ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে, একক দেশ হিসেবে, ভারতবর্ষে সবথেকে বেশি মানুষের প্রাণ হানি হয়েছে, এই সংখ্যাটা ছিল প্রায় দুই কোটির মত |
এর ভয়াবহতা এতটাই বেশি ছিল যে মানুষ কখনো কল্পনা করতে পারেনি | কোন মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে, একটু অসুস্থতা বোধ করছে এবং বিকেলের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়েছে | আবার কোন পরিবারের একজন সংক্রমিত হওয়ার ফলে গোটা পরিবার মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছে | কোথাও গোটা গ্রাম বা শহরের সমস্ত মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে | আবার কোন পরিবারের একজন সদস্যের অন্তিম সংস্কার করে ফিরতে না ফিরতেই, আরো একজন সদস্য মৃত্যুবরণ করেছে | সেই কারণে অন্তিম সংস্কারের জন্য মানুষ পাওয়া যেতনা, কারণ মৃতদেহ স্পর্শ করার মাধ্যমেও ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সেই ভয় মানুষের মানবিকতা কেড়ে নিয়েছিল | সে এক অন্যরকম ভীতিকর পরিস্থিতি, যা কখনোই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় |1919 সালের গৃষ্ম কালের থেকে এই ভাইরাসের প্রকোপ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে | ইতিমধ্যে যারা এই ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল তারা কিছু মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, আর কিছু মানুষের মধ্যে এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার মতো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল | তাই মৃত্যুর সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমতে থাকে | এবং 1920 সালে মৃত্যু সংখ্যা একেবারে লোপ পায় | এরপরেও পৃথিবীতে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দ্বারা বেশ কয়েকবার পৃথিবীর কয়েকটি দেশে মহামারী হয়েছে, কিন্তু তা স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী কে ছাড়িয়ে যায়নি |
বর্তমানে আবার একটি
covid-19 নামে নতুন ভাইরাস সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে, এই ভাইরাসের মারণ ক্ষমতা স্প্যানিশ ফ্লুর থেকে কম হলেও সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি, ফলে স্প্যানিশ ফ্লু এর থেকে দ্রুত গতিতে
করোনা ভাইরাস, সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে | বর্তমানের প্রচার মাধ্যম অনেক উন্নত হওয়ার ফলে দ্রুত এ রোগের বিস্তারিত সম্বন্ধে মানুষ জানতে পারছে, তাই আগে থেকেই সচেতনতা অবলম্বন করা সম্ভব হয়েছে | যে সমস্ত দেশ গুলো আগে থেকে সর্তকতা অবলম্বন করেনি, সে সমস্ত দেশে এই ভাইরাসের সংক্রমণ সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে | ভারতীয় উপমহাদেশে সঠিক সময়ে, লকডাউনের মত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে, সংক্রমণ বৃদ্ধির পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই কম | কিন্তু কিছু বুদ্ধিহীন মানুষের জন্য এই দেশে সংক্রমনের সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে গেছে | দেশের সমস্ত মানুষ যদি সচেতন থাকে, তাহলে ধারণা করা হচ্ছে, এই সংক্রমণ অনেকটাই রোধ করা সম্ভব হবে, তা নাহলে ভাইরাস যে
মহামারির আকার ধারণ করছে, তা
অন্যান্য মহামারী ছাড়িয়ে, স্প্যানিশ ফ্লুর আকার ধারণ করতে পারে | বিশেষজ্ঞদের কিছু অংশের ধারণা স্প্যানিশ ফ্লু গ্রীষ্মের থেকে যেমন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছিল, করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ও গ্রীষ্ম থেকে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে | জ্যোতিষ শাস্ত্রের বেশিরভাগ পন্ডিত রা এই কথার স্বীকৃতি দিয়েছেন |
শুধুমাত্র সচেতনতার মাধ্যমে এই ভাইরাসের সঙ্গে মোকাবেলা করা সম্ভব | সুতরাং আমাদের সকলের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে, ঘরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ, বাইরে বেরোনোটাই বিপদজনক | ইটালি থেকে একজন চিকিৎসক যিনি বর্তমানে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করছেন | তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানিয়েছেন, যে করোনা ভাইরাস কতটা ভয়াবহ, মানুষ জানলে বাইরে বেরোনো তো দূরের কথা, জালনা থেকে উকি মারার সাহস পর্যন্ত করত না | ভারতবর্ষের প্রাচীন অর্থশাস্ত্র বিদ,
চাণক্য পন্ডিতের উপদেশ হল শত্রু যখন অদৃশ্য তখন নিজেকে লুকিয়ে ফেলায় বুদ্ধিমানের কাজ |
তো বন্ধুরা সকলের কাছে আমারও একটি অনুরোধ অবশ্যই নিজেদের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, ঘরে থাকুন, অতি আবশ্যক কোন প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোবেন না | ঈশ্বর সকলের মঙ্গল করবে নমস্কার
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মতামত প্রকাশ করুন