জীবন মানেই পরিবর্তন: মহাভারতের আলোকে মানসিক বিপ্লব ও জ্যোতিষের গোপন মানচিত্র

![]() |
MyAstrology |
— জ্যোতিষ ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এক আত্মজিজ্ঞাসা
✍️ জ্যোতিষ ও হস্তরেখাবিদ্ প্রদ্যুৎ আচার্য
জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে, যখন চারপাশের সব কিছুই যেন নিজের বিরুদ্ধে কাজ করছে বলে মনে হয়। সহানুভূতির স্পর্শ দুর্লভ হয়ে ওঠে, সহযোগিতার আশ্বাস ফিকে হয়ে যায়। আপন মানুষগুলোও কেমন যেন নিজের হাত গুটিয়ে নিয়ে এক এক করে দূরে সরে যায়। তখন পাশে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, বিশ্বাস করার মতো কেউ খুঁজে পাওয়া যায় না।
এই সময়গুলো কি নিছকই কাকতালীয়, না কি এও গ্রহ-নক্ষত্রের গভীর প্রভাব?
দেখা যায়, কিছু মানুষ দীর্ঘদিন যাবৎ প্রচণ্ড চেষ্টা করেও কোনওভাবে সফল হতে পারছে না। আবার অন্য কেউ সামান্য প্রয়াসেই উল্লেখযোগ্য উন্নতি করে ফেলছে জীবনে। এমন অসম সমীকরণ কিসে নির্ধারিত হয়?
এগুলো কি শুধুই পরিশ্রমের তারতম্য, নাকি জ্যোতিষশাস্ত্রে বর্ণিত জন্মকালের গ্রহের অবস্থানেরই প্রভাব?
আপনি যদি জীবনে প্রচুর প্রচেষ্টা করেও ব্যর্থ হন, তবে হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই—যদি নিশ্চিত হন আপনি আপনার যোগ্যতা ও শক্তির শতভাগ দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন। সেই আত্মবিশ্বাসই হল আত্মমর্যাদার মূল।
আবার, আপনি যদি সফল হয়ে থাকেন, তবুও অহংকারের কোনও স্থান নেই। বরং কৃতজ্ঞ হওয়া উচিৎ সেই মহাশক্তির প্রতি, যিনি আপনাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন।
কারণ এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা আপনার থেকেও বেশি পরিশ্রম করেছেন, যাঁদের শিক্ষা, বুদ্ধি, প্রয়াস সব দিক থেকেই উন্নত ছিল, তবুও তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। এটাই প্রমাণ করে—
👉 মানুষ সফল হোক বা ব্যর্থ, তার জন্য সে একা কখনোই দায়ী নয়।
একজন মানুষের জীবন কতটা দূর এগোবে তা নির্ভর করে সে কোথায় জন্মেছে, কোন পরিবেশে বড় হয়েছে, কতটা শিক্ষা পেয়েছে, কী ধরণের সামাজিক ও পারিবারিক সহায়তা পেয়েছে, এবং তার জীবনে কারা এসেছে—এই সব কিছু মিলে।
এই অনিয়ন্ত্রিত দিকগুলিকেই আমরা বলি ভাগ্য।
এবং আমাদের মূল কাজই হল—এই ভাগ্যের সীমানাকে অতিক্রম করা। ভাগ্যের সাথে লড়াই করাটা খুবই কঠিন কাজ। কারণ এ এক অর্থে নিজের গড়ে ওঠা মানসিক গঠন, স্মৃতি, সীমাবদ্ধতা এবং ব্যর্থতার সাথে যুদ্ধ।
শৈশবে এক দাদুর মুখে শুনেছিলাম—“সমস্যারা পাঁচ ভাইবোন, একজন এলে বাকি চারজনও আসে, কিছুদিন থেকে আবার চলেও যায়।”
তখন মনে হতো এটা একটা মজার গল্প। কিন্তু বড় হয়ে দেখেছি—এই গল্পটাই জীবনের বাস্তব। এক সমস্যা কখনো একা আসে না।
তবুও আমাদের জীবনে তো বেঁচে থাকতে হবে, হাসতে হবে, ভালো থাকতে হবে। আর ভালো থাকার প্রধান শর্তই হলো—মনকে বোঝানো।
এই বোঝাপড়াটাই হল আমাদের বেঁচে থাকার আসল বিজ্ঞান।
এই প্রসঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-এর কথাই মনে পড়ে:
“হে অর্জুন, তুমি কেবল যথাযথ কর্ম করো। ফলের দিকে মন দিও না।”
“কর্মণ্যেৱাধিকাৰস্তে মা ফলেষু কদাচন” (ভগবদ্গীতা ২.৪৭)
অর্থাৎ তুমি যা করছো, সেই কর্মেই মনোনিবেশ করো। ফল কী হবে, সে চিন্তা ছেড়ে দাও। কারণ ফল আমাদের হাতে নেই, কিন্তু চেষ্টা—তা পুরোপুরি আমাদের হাতে।
আমরাও যদি আমাদের সবটুকু সামর্থ্য, প্রতিভা ও মন দিয়ে কর্ম করতে পারি, তাহলে সফলতা সম্ভব। আর যদি ব্যর্থও হই, তবু অন্তর থেকে বলতে পারি—“আমি আমার ১০০% দিয়েছি।” সেই আত্মতৃপ্তিই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে সিসিফসের কাহিনি—
গ্রিক পুরাণের সেই চরিত্র, যিনি দেবতাদের অভিশাপে অনন্তকাল ধরে একটি বিশাল পাথর গড়িয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন—পাথরটি আবার গড়িয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে।
এই অসার ও ব্যর্থ চেষ্টাই তার চিরন্তন কাজ।
আলবেয়ার কামু তাঁর প্রবন্ধ “The Myth of Sisyphus”-এ লেখেন:
“One must imagine Sisyphus happy.”
অর্থাৎ, জীবন যদি অর্থহীনও হয়, আমরা যদি সেই অর্থহীনতাকেই মন থেকে গ্রহণ করি, তাহলে তার মধ্যেই আমরা সুখ খুঁজে পেতে পারি।
এই বোকা মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে আর কোনও বিকল্প নেই। তাই আমি আমার জীবনের বর্তমানকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেছি।
যেটুকু আমার হাতের মধ্যে আছে, সেটুকুই পূর্ণ মনোযোগে করতে চেষ্টা করি। এখন আর ব্যর্থতার ভয় পাই না।
জিডু কৃষ্ণমূর্তি বলেছিলেন:
“Truth is a pathless land.”
আমরা যেখানেই থাকি না কেন, জীবন কেবল বর্তমান মুহূর্তেই ঘটে। অতীত স্মৃতি কিংবা ভবিষ্যতের কল্পনা—দুটোই বাস্তবের বাইরে।
এই মুহূর্তই সত্য। এই মুহূর্তেই কাজ সম্ভব। অতীত বা ভবিষ্যৎ নয়।
আমি বিশ্বাস করি, ঈশ্বর আমাকে সৃষ্টি করার আগে আমার জীবনে যা যা লাগবে—তা ভাগ করে দিয়েছেন: জ্ঞান, সাহস, প্রতিভা, বুদ্ধি, সহনশীলতা।
তাই আমি ভবিষ্যতের ফল নিয়ে চিন্তা করি না। আমি শুধু এখন এই মুহূর্তে যা কিছু করা সম্ভব, তাই করি সম্পূর্ণ মন দিয়ে।
এখানে ইমানুয়েল কান্ট-এর কথা মনে পড়ে। তিনি বলেন:
“Though we cannot know God or soul through pure reason, we must believe in them for moral and practical life.”
বস্তুত, যুক্তি ও বিজ্ঞান দিয়ে অনেক কিছু বোঝা যায়, কিন্তু তার সীমা আছে।
যখন সেই সীমার বাইরে প্রশ্ন উঠে আসে—তখনই আমাদের প্রয়োজন হয় আস্থা, বিশ্বাস, ধর্ম ও দর্শনের।
এই বিশ্বাসগুলোকে না ভেঙে বরং বোঝা উচিত—যা যুক্তি ও বিজ্ঞান দিয়ে চলে, তা এক জগৎ। আর যা মান্যতা দিয়ে চলে, তা আরেক জগৎ।
দুটোই সত্য, যদি আমরা বোঝার দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে পারি।
জীবন কখনোই একরৈখিক নয়।
তবে জীবন মানেই চেষ্টা—নিজের সঙ্গে, ভাগ্যের সঙ্গে, অস্তিত্বের সঙ্গে।
আলো না থাকলেও, আলো খোঁজার চেষ্টাটা চালিয়ে যেতে হবে।
“অন্ধকার যত গভীর হয়, প্রভাত তত কাছাকাছি।”
ধন্যবাদ 🙏
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মতামত প্রকাশ করুন