দীক্ষা ও সত্যপথ: আত্মসমর্পণ ও চিরস্থায়ী মুক্তি – শেষ অংশ
![]() |
My Astrology Ranaghat |
চিরশত্রুর মিলন ও মুক্তি: অহংকার ভাঙার মহাগাথা
লেখক: প্রদ্যুত আচার্য
পেশা: জ্যোতিষী ও হস্তরেখাবিদ, দার্শনিক চিন্তাবিদ
ভুবন শেঠ ও বিবেক বাবু একসাথে গুরুদেবের আশ্রমে পৌঁছালেন। ভুবন শেঠ ধীরস্থির কণ্ঠে বললেন—
“গুরুদেব, আজ আমার ঝুলি পূর্ণ হয়েছে। আজ আমি শুধু খাদ্য বা দ্রব্য সমর্পণ করিনি, আমি আমার অহংকারের শেষ বাঁধনও এখানে সমর্পণ করেছি।”
গুরুদেব ঝুলির দিকে তাকালেন, তারপর ধীর হাসি মুখে বললেন—
“ভুবন, এবার সত্যিকার দক্ষিণা পূর্ণ হয়েছে। তোমার আসল দক্ষিণা ছিল এই আত্মসমর্পণ। তুমি সংগ্রহ করেছো শুধু খাদ্যের জন্য নয়, নিজের হৃদয়কে খোলা ও শত্রুকে ক্ষমা করার শক্তি অর্জনের জন্য। এটাই প্রকৃত ভিক্ষা।”
তারপর গুরুদেব বিবেক বাবুর দিকে চোখ দিয়ে দেখলেন—
“বিবেক, তুমি যে নিজের হৃদয় সমর্পণ করেছ, এটাই তোমার সত্যিকার দক্ষিণা। তোমরা দু’জন একসাথে সত্যের দ্বারে প্রবেশের যোগ্য।”
আশ্রমের নীরবতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালো। শিষ্যরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে, গুরুদেবের এই মুহূর্তের মহত্ত্ব অনুভব করছিল। ভুবন শেঠ ও বিবেক বাবু একসাথে দীক্ষা নিলেন। গুরুদেব মাথায় করুণার হাত রাখলেন এবং বললেন—
“স্মরণ রেখো, ধন-সম্পদ নয়, অহংকার নয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতাও নয়—মানুষের আসল কাজ হলো নিজের অন্তরের অন্ধকার ভাঙা। সত্যের পথে চলতে হলে সবচেয়ে আগে নিজেরই পরাজয় ঘটে যেতে হবে।”
ভুবন শেঠের চোখ ভিজে উঠল। তিনি উপলব্ধি করলেন—আজ তিনি আর ধনী ব্যবসায়ী নন, আজ তিনি সত্যপথের ক্ষুদ্র যাত্রী। বিবেক বাবুর সঙ্গে তাঁর মিলন হলো সেই যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ।
সন্ধ্যা নামল আশ্রমে। প্রদীপের আলোয় গুরুদেবের কণ্ঠ যেন মহাভারতের কোনো শ্লোকের মতো ধ্বনিত হলো—
মুক্তি ও আত্মার দার্শনিক উপলব্ধি
সত্যিকারের মুক্তি কী?
“কেউ তোমাকে বাঁধেনি। তুমি নিজের মায়া ও কল্পনার জালে আবদ্ধ। তাই মুক্তি বলতে কিছু নেই—কারণ কখনো তুমি আসলেই বদ্ধ ছিলে না। মুক্তির চিন্তাই বন্ধন। তুমি শুদ্ধ সচ্চিদানন্দস্বরূপ, সর্বদা মুক্ত।”
আত্মা কিভাবে মুক্ত?
“আত্মা সব বন্ধনের অতীত। সে কখনো সংসারে আবদ্ধ হয়নি। ‘আমি বদ্ধ’—এই ভ্রান্ত ধারণা বন্ধন। ‘আমি মুক্ত’—এই জ্ঞানই মুক্তি। যখন তুমি নিজেকে দেহ-মন-ইন্দ্রিয় নয়, অনন্ত চৈতন্যস্বরূপ জানবে, তখনই বুঝবে আত্মা সদা মুক্ত।”
সংসারের প্রকৃতি কী?
“সংসার তোমার জন্য কোনো বাস্তব অর্থ বহন করে না। সংসার হলো মায়ার খেলা, চৈতন্যে আভাসমাত্র। যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রান্তি, তেমনি চৈতন্যে সংসারভ্রান্তি। যখন তুমি জ্ঞাননেত্রে দেখবে, তখন বুঝবে—এ ঘর, পরিবার, দুনিয়া কিছুই সত্য নয়। একমাত্র ব্রহ্মই সত্য।”
আমি কে?
“‘আমি’—এই প্রশ্নই বন্ধনের মূল। তুমি কে? তুমি সেই অশ্বথবৃক্ষের মতো, যার শিকড় আকাশে, ডালপালা মাটিতে—এক বিভ্রম। যাকে তুমি ‘আমি’ বলো, তা দেহ নয়, মন নয়, বুদ্ধি নয়, অহংকার নয়। নাম, রূপ, গোত্র, জাতি, পেশা—সব পোশাক মাত্র। তুমি সেই নির্বিশেষ সচ্চিদানন্দ, শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ, অদ্বয়, নিরাকার ও নিরুপাধি।”
“‘আমি দেহ’—এই অজ্ঞান সংসার। ‘আমি ব্রহ্ম’—এই জ্ঞানই মুক্তি। সব পরিচয় মুছে ফেলে, যে থাকে—সেই তুমি।”
সরল দর্শন:
“চিন্তা ছাড়াও, কোনো ভাবনা ছাড়াই দেখো—তখনই তুমি জানতে পারবে তুমি কে।”
চূড়ান্ত শিক্ষা
“যে অহংকার ভাঙতে পারে, সে-ই মুক্তির স্বাদ পায়।
যে ক্ষমা করতে পারে, সে-ই সত্যের আলোয় বাঁচে।
আর যে শত্রুর দ্বারে ভিক্ষার ঝুলি পাততে পারে, সে-ই প্রকৃত ভিক্ষুক, প্রকৃত সাধক।”
ভুবন শেঠ ও বিবেক বাবু গুরুদেবের চরণে প্রণাম করে শুয়ে পড়লেন। তাদের মনে তখন আর কোনো প্রতিযোগিতা নেই, কোনো অশান্তি নেই—শুধু শান্ত, বিনম্র ও গভীর উপলব্ধি।
ধন-সম্পদ মানুষকে সম্মান দিতে পারে, কিন্তু অন্তরের শুন্যতা পূরণ করতে পারে না।
অহংকারই মানুষের প্রকৃত বাধা।
শত্রুকেও ক্ষমা করার মধ্যে লুকিয়ে আছে সর্বোচ্চ মুক্তি।
গুরুদক্ষিণা কখনো ধনে নয়—নিজের অহংকার ভেঙে আত্মসমর্পণে।
ভুবন শেঠ ও বিবেক বাবুর জীবন হয়ে উঠল এক মহাগাথা—যেখানে শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে জন্ম নিল ভ্রাতৃত্ব, ক্ষমা, শান্তি এবং সত্যপথের যাত্রা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মতামত প্রকাশ করুন